Dr Zaki Rezwana Anwar FRSA
বহু প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গত সপ্তাহে মুক্তি পেল জর্জ মার্টিনের ফ্যান্টাসি বই ‘ফায়ার এন্ড ব্লাড’ অবলম্বনে নির্মিত ‘হাউজ অব দ্য ড্রাগন’। মার্টিনের বইয়ের উপর ভিত্তি করে হিট ফ্যান্টাসি সিরিজ ‘গেম অফ থ্রোনস’ এর প্রিক্যুয়েল এটি। এতে দেখা যাবে টারগারিয়ান রাজ পরিবারের বিভিন্ন কাহিনী যাতে থাকবে একটি নারী চরিত্র কিভাবে তাঁর প্রতিপক্ষদের হারিয়ে সিংহাসন দখল করে। ‘হাউজ অফ দ্য ড্রাগন’ এর মুক্তির সময়কাল এবং প্রেক্ষাপটটি কী আশ্চর্যজনকভাবে একেবারে বর্তমান বৃটিশ রাজনীতির সাথে মিলে গেল! লিজ ট্রাসই হতে যাচ্ছেন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী – এটি এখন এক রকম ধরেই নেওয়া যায়।
বৃটেনে যখন মূল্যস্ফীতি, ব্যাংক অফ ইংল্যান্ডের সুদের হারের উর্ধ্ব গতি, গগণচুম্বী জ্বালানী মূল্য, রেল ধর্মঘট আর এন এইচ এস এর দীর্ঘ ওয়েটিং লিষ্ট তখন বৃটিশ রাজনীতির ময়দানের দিকে তাকালে মনে হয় কনজারভেটিভের নেতৃত্বের লড়াই যেন চলছে অন্য কোনো এক গ্রহে। ক্ষমতাসীন ও প্রাক্তন কনজারভেটিভ এমপিদের অনেকেই লিজ ট্রাসের ব্যাক্তিত্ব ও পলিসিগুলোর সমালোচনা করার পরও এটা বলাই যায় যে একজন প্রধানমন্ত্রী যদি চৌকস, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা সম্পন্ন মন্ত্রীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হন তাহলে সেই প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য এবং দেশের অগ্রগতির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে এবার এটাও লক্ষ্য করা গেছে যে নেতৃত্বের লড়াইকে কেন্দ্র করে কনজারভেটিভ দলের মধ্যে যেভাবে তিক্ততার সৃষ্টি হয়েছে, যেভাবে দলের মধ্যে মেরুকরণ হয়েছে তা আগের কোনো নেতৃত্বের লড়াইয়ে দেখা যায় নি। এই লড়াইয়ে লিজ ট্রাস জিতে যাবেন ঠিকই তবে এই দৌড় প্রক্রিয়ায় দলের মধ্যে সৃষ্টি হল ফাটলের আর সেই সাথে লিজ ট্রাস নিজের জন্যে তৈরী করলেন কিছু শত্রু।
তবে কথা হচ্ছে বৃটেনের অর্থনৈতিক দু:সময়ে লিজ ট্রাস কি সেসব বিভেদ ভুলে গিয়ে নিজের বলয়ের বাইরে গিয়ে দলের সব প্রতিভাবান, যোগ্য, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আছে এমন এমপিদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করবেন নাকি যোগ্যতা সম্পন্ন এমপিদের পলিটিকাল সাইবেরিয়াতে পাঠিয়ে দেবেন?
যদি লিজ ট্রাস ঋষি সুনাককে তাঁর মন্ত্রীসভায় রাখতে পারতেন বা ঋষি সুনাক থাকতে রাজী হতেন তাহলে দলের জন্যে এবং বিশ্বের সামনে একটি ভাল উদাহরণ হয়ে থাকতো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রেগান যেভাবে তার কড়া সমালোচক সিনিয়র বুশকে তাঁর প্রসিডেন্ট করে নিয়ে এসেছিলেন লিজ ট্রাস যে সেরকম উদারতা বা বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারছেননা তা এখন আমাদের কাছে পরিস্কার। বরিস জনসন ও জেরেমি হান্ট ছিলেন নেতৃত্বের লড়াইয়ে টিকে থাকা শেষ দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই জেরেমি হান্টকে কি বরিস জনসন মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন নি?
এরপর যদি ডমিনিক রাবের কথায় আসি – ডমিনিক রাব যদিও লিজ ট্রাসের অর্থনৈতিক পলিসিকে নির্বাচনের জন্যে আত্মঘাতী বলেছেন তারপরও লিজ ট্রাসের উচিত ছিল নেতৃত্বের লড়াইকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দলের মধ্যে দৃশ্যমান বিভেদের উর্ধ্বে উঠে ডমিনিক রাবের মন্ত্রীসভায় থাকার পথ রূদ্ধ না করা। এদিকে মাইকেল গোভ ও লিজ ট্রাসের মধ্যে মতবিরোধ এক পুরনো বিষয় বিশেষ করে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে- লিজ ট্রাস বরাবরই মুক্ত বাজারে বিশ্বাসী এবং মাইকেল গোভ এ ব্যাপারে অনেকটা রক্ষণশীল। অনেকদিন নীরব থাকার পর মাইকেল গোভ শেষের দিকে লিজ ট্রাসের সমালোচনায় মুখর হয়ে ঋষি সুনামকে সমর্থন দিলেন।
অর্থনীতিতে মুক্ত বাজারে বিশ্বাসী ও লিজ ট্রাসের মত বৃটিশ জনগণকে অলস মনে করে – এমন চ্যান্সেলারই চাই লিজ ট্রাসের। প্রাক্তন বিসনেস সেক্রেটারি কোয়াজি কোয়ার্টাঙ লিজের মতই মুক্ত বাজারে বিশ্বাসী এবং লিজের সুরে সুর মিলিয়ে বলেছেন বৃটিশ নাগরিকদের অলসতা ছেড়ে আরো দক্ষ ও কর্মঠ হওয়া উচিত।
স্যুয়েলা ব্রেভারমম্যান যখন নেতৃত্বের লড়াইয়ে নেমেছিলেন তখন তাঁর প্রচারণা দেখে মনে হয়েছিল তিনি কনজারভেটিভ নেতা হওয়ার জন্যে লড়ছেন না বরং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটির জন্যে ‘জব ইন্টারভিউ ‘ দিচ্ছেন। বরিস জনসন প্রীতি পাটেলকে দিয়ে যতটা অপ্রিয় কাজ করাতে পেরেছিলেন তার দ্বিগুণ পরিমাণ অপ্রিয় কাজ লিজ ট্রাস করাতে পারবেন স্যুয়েলা ব্রেভারম্যানকে দিয়ে। ২০২০ সালে স্যুয়েলা এটর্নি জেনারেল পদে উন্নীত হলে তার ব্যরিষ্টার সহকর্মীদের মধ্যে পর্যন্ত উদ্বেগ দেখা দিয়েছিল। স্যুয়েলা ব্রেক্সিটের পর ইইউ নাগরিকদের বৃটেনে থাকতে দেওয়ার বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, তিনি নেতৃত্বের লড়াইয়ে খুব বেশীদিন টিকে ছিলেন না তবে তার মধ্যেই রোয়ান্ডা স্কীমকে বর্ধিত করা কথা বলেছিলেন।
জেমস ক্লেভারলি ২০১৫ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর পররাষ্ট্র দপ্তরে মন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন এবং বর্তমান অকার্যকর মন্ত্রীসভায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্ব পাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই এ লেভেলের পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিয়ে ব্যর্থতার কারণে পদত্যাগের দাবীর মুখে পড়েছেন তিনি। ক্লেভারলি এবং লিজ ট্রাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বায়িত্বে থাকা মোটামুটিভাবে একই কথা বলে ধরে নেওয়া যায়।
কথা হচ্ছে এমন একটি একচোখা মন্ত্রীসভা, সেইসাথে একের পর এক বিভিন্ন সেক্টরে ধর্মঘটে জনজীবন ধীরে ধীরে স্থবির হয়ে যাওয়ার পরও কি কিয়ার ষ্টার্মার মার্গারেট থেচার যেভাবে একই ধরনের পরিস্থিতিতে জেমস কালাহানকে পরাজিত করেছিল সে রকমটি পারবেন? তখনকার চরম দুর্দিনে বলিষ্ঠভাবে ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষমতা সীমিত করার মত স্পষ্ট পলিসির উপস্থাপনই মার্গারেট থেচারকে জনপ্রিয় করে তুলছিল। থেচারের এই পলিসির সমালোচনা আমরা করতেই পারি, তবে কিয়ার ষ্টার্মার কি পারবে এভাবে পরিস্কার করে বলিষ্ঠভাবে লেবারের পলিসিগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে?
মনে রাখতে হবে আসছে নির্বাচনে ইউকের জন্যে লেবারের বিজয় এবং লেবারের সরকার গঠন করা দু’টো পটভূমির মধ্যে ফারাক অনেক। যদি এসএনপি -এর সাথে মিলে লেবারের সরকার গঠন করতে হয় তাহলে ইউকের মানচিত্র বদলে যেতে পারে দ্রুত। এত কিছুর ভেতরে বরিস জনসনকেও সমীকরণ থেকে বাদ দেওয়া যাবেনা। বরিসের কন্ঠে, ‘হাষ্টা লা ভিষ্টা বেবী’ (অর্থাৎ আবার দেখা হবে) কথাটা বার বারই কানে বাজে।
দেখে শুনে বোঝা যাচ্ছে লিজ ট্রাস দলকে একেবারে রোবোটিক ভাবে চূড়ান্ত ডান দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। শুধু কি লিজ ট্রাস? গত কয়েক বছরে তথাকথিত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সুবিধেবাদী ও পপুলিষ্ট রাজনীতিবিদরাই ভোট পেয়ে আসছে। ইটালির বারলোষ্কনি (এবং অদূর ভবিষ্যতে সম্ভবত মেলোনি), ফ্রান্সে সার্কোজি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প, ইউকেতে বরিস জনসন, হাঙেরিতে আরবান, ব্রাজিলে বলসোনারো, তুরস্কে এরদোয়ান – এঁরা সবাই যতটা চটকদার কথা বলে ক্ষমতায় এসেছে ততটা করেনি দেশের মঙ্গলের জন্যে। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে পারে একমাত্র ভোটাররা — একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।।
লেখক ডা: জাকি রেজোওয়ানা আনোয়ার এফ আর এস এ একজন চিকিৎসক, জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক ও কলামিস্ট।