মশাহিদ আলী: ঘরের বারান্দায় অপলক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে অবুঝ দুই শিশু। তাদের বাবা হয়তো ফিরে আসবেন! কিন্তু না, তাদের বাবা যে আর কোনোদিনও ফিরবে না। তারা পাবে না তাদের বাবার আদর-স্নেহ। আড়াই মাসের শিশু খাদিজা জান্নাতও কোনোদিন তার বাবাকে দেখবে না। তার বাবাও শুনবে না তার মুখে বাবা ডাক। বাবা কোথায় আছেন? তা হয়তো জানেই না এই ছোট্ট শিশুটি।
তবে বাবাকে যে হত্যা করা হয়েছে, তা অবশ্য জানে ৮ বছরের শিশু ইশা জান্নাত তানহা। তাইতো বাবার হত্যাকারীদের বিচার চাইলো সে। শুধু ইশা নয়, তাদের পুরো পরিবারের দাবি একই।
গত ৪ আগস্ট দুপুর ২টার দিকে বাড়ির পাশেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ-বিজিবি ও ছাত্র জনতার সংঘর্ষ হয়। ওইদিন গোলাপগঞ্জ উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি অভিজিৎ চৌধুরীর নির্দেশে পুলিশ ও বিজিবি গুলি ছুড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সিলেটের গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার বারকোট গ্রামের মৃত মকবুল আলীর ছেলে ব্যবসায়ী তাজ উদ্দিন (৪০)। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে তাজ উদ্দিন ছিলেন সবার বড়। পরিবারের বড় ছেলেকে হারিয়ে নিদ্রাহীন তাদের দিন কাটছে তাদের।
ঘটনার ২২দিন পেরিয়ে গেলেও পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো দায়ের করা হয়নি কোনো মামলা। পরিবারের লোকজন বলছেন-পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য না থাকায় তারা সময় নিচ্ছেন। তবে প্রবাসী দুই ভাইর মধ্যে কেউ দেশে এলে আলাপ-আলোচনা করে মামলা দায়ের করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা। পুলিশ বলছে- নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে মামলা দায়ের করার জন্য।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে তাজ উদ্দিনের ছিল মুদির দোকান। সেখানকার আয় দিয়ে চলতো পরিবার।
সরেজমিনে গোলাপগঞ্জের ধারাবাহর গ্রামে নিহত তাজ উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বৃদ্ধ মা সুফিয়া বেগম, ছোটবোন ও স্ত্রী, দুই সন্তান রয়েছেন। ছেলেকে হারিয়ে মা বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, আর বোন বড় ভাইকে হারিয়ে ভাই ডাকতে না পারার আক্ষেপ করছেন। স্ত্রী ডলি বেগম (৩২) আড়াই মাসের শিশু কন্যা খাদিজা জান্নাতকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। হয়তো বসে বসে ভাবছেন, তার কিংবা এ অবুঝ শিশুর ভাবিষ্যত নিয়ে! আর ৮ বছরের ইশা জান্নাত তানহা এদিক ওদিক ঘুরছে।
নিহতের চাচাতো ভাই রিমাদ আহমদ সেই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ৪ আগস্ট আমাদের এলাকায়ও আন্দোলন চলছিল। আমার ভাইও ছিলেন সেদিনের মিছিলে। পেছন দিক থেকে কিছু মানুষ মিছিল নিয়ে আসে। এসময় গোলাপগঞ্জ পৌর এলাকার দিকে পুলিশ ও বিজিবি আসছিল। এসময় তাদেরকে ইট পাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন গোলাপগঞ্জ উপজেলার এসিল্যান্ড অভিজিৎ চৌধুরীর নির্দেশে পুলিশ ও বিজিবি গুলি ছুড়ে। তখন আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এসিল্যান্ড ফায়ার করার জন্য অর্ডার দেন।
তাজ উদ্দিনের ছোটবোন হালিমা বেগম বলেন, আমাদের ঘরে কোনো পুরুষ নেই। এখন পর্যন্ত আমরা মামলা করিনি বা এমন প্রস্তুতিও নেই। যেহেতু আমার ভাই বিদেশ রয়েছেন। তারা দেশে আসার পর আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা চাই না অহেতুক মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি করতে।
দেশবাসীর কাছে বিচার চেয়ে তিনি বলেন, বিনা অপরাধে যে প্রশাসনে আমার ভাইকে গুলি করে মেরেছে তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার আমরা চাই। আমাদের ৬ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। তিনি আমাদের সংসার চালিয়েছেন। এখন আমরা খুব অসহায় হয়ে পড়েছি।
কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি আরও বলেন, ছোট ছোট দুটি বাচ্চা রয়েছে। আমার আম্মা একজন বয়স্ক মানুষ। আজ ২২দিন ধরে আমাদের কারো রাতে ঘুম হয় না। প্রতিদিন রাতে বাচ্চা দুটি ফোন নিয়ে তাদের বাবাকে খোঁজে। যখন ৮ বছর বয়স ছিল, তখন থেকে বড়ভাই সংসারের হাল ধরেন। আমাদের সবার মায়ার বড় ভাই ছিলেন। তাই সারাজীবন আমরা ভাই ডাকার আক্ষেপ থেকে যাবে। আজ সবাইকে ছেড়ে তিনি দুনিয়া থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু কী অপরাধ ছিল আমাদের পরিবারের? কেন আমার ভাইকে এভাবে মারা হলো?
নিহতের মেয়ে ইশা জান্নাত তানহা বলেন, ‘আমার আব্বাকে যারা মারছে, তারার বিচার চাই আমি। আব্বা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কোনো কিছু বলে যাননি।’
এ ব্যাপারে সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মীর মো.আব্দুন নাসের বলেন, ৬টি হত্যার ঘটনার মধ্যে তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। বাকিগুলো দায়ের করা হবে। তার জন্য আমরা নিহতদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। সঠিক তদন্তের মাধ্যমে মামলা যাচাই করা হবে। যাতে কোনো নিরপরাধ মানুষ হয়রানির শিকার না হয়।