মোহাম্মদ আলীর পায়ে বল লাগতেই আবেদন মুখর সবাই। আঙুল তুলে দিলেন আম্পায়ারও। শেষ চেষ্টা হিসেবে তখন রিভিউ নেওয়ার ইঙ্গিত দিলেন আলী। কিন্তু বোলার মেহেদী হাসান মিরাজ নিশ্চিত, আউট হয়ে গেছেন ব্যাটার। সতীর্থদের ভরসা জুগিয়ে আম্পায়ারের কাছ থেকে ক্যাপ নিতে এসেও দিলেন একই বার্তা।
তখন মিরাজের চোখেমুখে উচ্ছ্বাস, দারুণ কিছু করে দেখানোর তৃপ্তিও। ঐতিহাসিক জয়ের জন্য তাদের যে তখন কেবল আনুষ্ঠানিকতাই বাকি। তীব্র আকাঙ্ক্ষা, জয়ের জন্য ক্ষুধা ও মনোযোগ; একটি স্মরণীয় মুহূর্তের সাক্ষী করেছে মিরাজদের, আনন্দে ভাসিয়েছে নানা বিপদের ভেতর দিয়ে যাওয়া দেশকেও। মিরাজের হাসিতেও হয়তো থেকেছে তারই ছাপ।
রাওয়ালপিন্ডিতে দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথমটিতে পাকিস্তানকে ১০ উইকেটে হারিয়েছে বাংলাদেশ। নিজেদের মাটিতে এবারই প্রথম ১০ উইকেটে হারল পাকিস্তান।
প্রথম ইনিংসে ৬ উইকেট হারিয়ে ৪৪৮ রান করে ইনিংস ঘোষণা করে স্বাগতিকরা। পরে নিজেদের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশ অলআউট হয় ৫৬৫ রানে। দ্বিতীয় ইনিংসে পাকিস্তান ১৪৬ রানে অলআউট হলে সফরকারীদের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় স্রেফ ৩০ রানের।
পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৪তম টেস্টে এসে প্রথম জয় পেলো বাংলাদেশ। এর আগে তাদের মাটিতে আগে কখনো ড্রও করতে পারেনি তারা। পাকিস্তানের বিপক্ষে একটি ম্যাচেই ড্র করতে পেরেছিল বাংলাদেশ, ২০১৫ সালে খুলনায় হয়েছিল সেটি।
শেষদিনের শুরুটা দারুণ হয় বাংলাদেশের। দ্বিতীয় ওভারের শেষ বলে শান মাসুদকে আউট করেন হাসান মাহমুদ। শুরুতে অবশ্য আম্পায়ার আউট দেননি। পরে রিভিউ নিলে রিপ্লেতে দেখা যায় মাসুদের ব্যাট ছুঁয়েই বল যায় উইকেটের পেছনে দাঁড়ানো লিটন দাসের গ্লাভসে। ৩৭ বলে ১৪ রান করেছিলেন মাসুদ।
এরপর ওপেনার আব্দুল্লাহ শফিককে নিয়ে দলের হাল ধরেন বাবর আজম। এবার দলকে সাফল্য এনে দেন নাহিদ রানা। তার বল ইনসাইড এজ হয়ে চলে যায় ৫০ বলে ২২ রান করা বাবরের স্টাম্পে। পরের ওভারে এসে পাকিস্তানকে আরও চাপে ফেলে দেন সাকিব আল হাসান।
তার বলে স্টাম্পিং হন চার বলে কোনো রান না করা সৌদ শাকিল। নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো ডাক মারেন এই ব্যাটার। তাকে ফেরানোর পর মরিয়া হয়ে ওঠেন নানাদিক থেকে চাপের মুখে থাকা সাকিব। প্রতিটি বলই তিনি করছিলেন ভীষণ মনোযোগ দিয়ে।
৩৩তম ওভারের প্রথম বলে রিজওয়ানের প্যাডে বল লাগলে এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করে বাংলাদেশ। আম্পায়ার আউট না দিলে রিভিউ নিতে চায় তারা, কিন্তু ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে ১৫ সেকেন্ড সময়।
সাকিব পরের বল করতে গেলে উইকেট থেকে সরে যান রিজওয়ান। তখন হাওয়ায় বল ছুড়ে মারেন সাকিব, সেটি লিটন ধরেন। আম্পায়ার এরপর এ নিয়ে অসন্তোষও জানান। ওই ওভারের শেষ বলে বোল্ড হয়ে যান আব্দুল্লাহ শফিক। ৮৬ বলে ৩৭ রান করে সাজঘরে ফেরত যান তিনি।
এই চাপ আরও বেড়ে যায় এক বল পরই সালমান আগা আউট হলে। কোনো রান করার আগেই স্লিপে দাঁড়ানো সাদমান ইসলামের হাতে ক্যাচ দেন তিনি। সেশনের বাকি সময়টুকু শাহিন শাহ আফ্রিদিকে নিয়ে কাটিয়ে দেন মোহাম্মদ রিজওয়ান।
বিরতি থেকে ফেরার এক ওভার পরই মিরাজের বলে এলবিডব্লিউ আউট হন শাহিন শাহ আফ্রিদি। এরপর নাসিম শাহকে আউট করেন সাকিব। তবুও বাংলাদেশের জয়ের পথে কাঁটা হয়েছিলেন রিজওয়ান। তার ব্যাটে চড়েই লড়াই করার স্বপ্ন দেখতে থাকে পাকিস্তান।
আগের ইনিংসে দেড়শ ছাড়ানো ইনিংস খেলা রিজওয়ান এবারও পেয়ে যান হাফ সেঞ্চুরি। তাকে দারুণ সঙ্গ দিচ্ছিলেন খুররম শেহজাদও। বাংলাদেশের হতাশাটা লম্বা হতে দেননি মিরাজ। তার বলে সুইপ করতে গিয়ে বল স্টাম্পে টেনে আনেন রিজওয়ান। ৮০ বলে ৫১ রান আসে এই উইকেটরক্ষকের ব্যাট থেকে।
তার বিদায়ের পর পাকিস্তানের অলআউট হতেও আর বেশি সময় লাগেনি। ১৪৬ রানে অলআউট হয়ে যায় তারা, বাংলাদেশের বিপক্ষে যেটি তাদের টেস্টে সর্বনিম্ন। মিরাজ চার ও সাকিব নেন তিন উইকেট। বাংলাদেশের সামনে লক্ষ্য দাঁড়ায় স্রেফ ৩০ রানের।
রান তাড়ায় নেমে কোনো উইকেটই হারাতে হয়নি বাংলাদেশকে। দুই ওপেনারই বাংলাদেশকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। সালমান আগাকে সুইপ করে চার হাঁকিয়ে জয় নিশ্চিত করেন জাকির। এরপর ড্রেসিংরুমের দিকে যায় ক্যামেরা, তখন প্রতিটি সদস্যই উচ্ছ্বাসে ভাসছেন; তাদের সঙ্গে হয়তো দেশের মানুষও। টেস্ট খেলুড়ে দেশের মধ্যে এখন শুধু দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত বাদে সবাইকে হারাল বাংলাদেশ।