বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্য অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে একটি নতুন সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করার বিষয়ে বিবেচনা করতে সম্মত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৬.৪ বিলিয়ন ডলার।দুই দেশ ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগের জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য থেকে ৫৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) পেয়েছে, যা ২০২২ সালে কোনো দেশ থেকে পাওয়া সর্বোচ্চ এফডিআই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অত্যন্ত উষ্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ ও বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ৫ম বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য কৌশলগত সংলাপে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।এই সংলাপের নেতৃত্বে ছিলেন যথাক্রমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাজ্যের এফসিডিও’র স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা, অভিবাসন, জলবায়ু, উন্নয়ন অংশীদারিত্ব ও গতিশীলতাসহ দুই কমনওয়েলথ দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক সম্পর্কের সার্বিক পর্যালোচনা করেন। যুক্তরাজ্যের পক্ষ থেকে গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্জিত উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হিসাবে যুক্তরাজ্যের বাজারে টেকসই প্রবেশ সহায়তার প্রশংসা করে, ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলডিসি দেশে উন্নীত হওয়ার পরও ২০২৯ সাল পযন্ত এটা অব্যহত রাখার আহ্বান জানান।বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য অভিবাসন ও গতিশীলতা- বিশেষত যুক্তরাজ্যে নার্সিং, আতিথেয়তা, কৃষি, নির্মাণ ও রাজমিস্ত্রিসহ অন্যান্য সেবা খাতে লাভজনক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে সম্মত হয়েছে। উভয় পক্ষ অভিবাসন, গতিশীলতা ও যোগ্যতার পারস্পরিক স্বীকৃতি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠনে সম্মত হয়েছে। তারা যুক্তরাজ্যে অনিয়মিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশী নাগরিকদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে একটি এসওপি স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে। ২০২২ সালে স্টুডেন্ট, ভিজিট এবং বিজনেস ভিসা উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ যুক্তরাজ্য সরকারকে ধন্যবাদ জানায়। উভয় পক্ষ ফৌজদারি বিষয়ে পারস্পরিক আইনী সহায়তা নিয়েও আলোচনা করেছে।
চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে স্বাক্ষরিত জলবায়ু চুক্তির কথা স্মরণ করে উভয় পক্ষই দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিকভাবে জলবায়ুু সংক্রান্ত কর্মকা-ে সহযোগিতা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তারা একটি নেট-জিরো ও প্রকৃতি-বান্ধব বিশ্বের লক্ষ্যে জলবায়ু চুক্তির অধীনে সময়োপযোগী একটি জয়েন্ট এ্যাকশন প্ল্যানে স্বাক্ষর করতেও সম্মত হয়েছে। যুক্তরাজ্য পক্ষ বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, সহিংসতামুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে উৎসাহিত করেছে। তারা বাংলাদেশের টেকসই অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরেন।
বাংলাদেশ পক্ষ একটি ন্যায্য, শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য এসডিজি১৬-এর অধীনে তার জাতীয় লক্ষ্যগুলো নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব সন্ত্রাস, সহিংস চরমপন্থা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি পুনর্ব্যক্ত করেন।উভয় পক্ষই ভারত মহাসাগরে সামুদ্রিক ও বিমান চলাচলের নিরাপত্তার পাশাপাশি চরমপন্থী ও সন্ত্রাসী সংগঠনের মোকাবিলাসহ পারস্পরিক স্বার্থের বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা ইস্যুতে সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সম্মত হয়েছে।উভয় পক্ষ সাইবার-নিরাপত্তায় সহযোগিতার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অন্বেষণে সম্মত হয়েছে। যুক্তরাজ্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের অধীনে বিশ্ব শান্তিতে বাংলাদেশের অগ্রণী অবদানের প্রশংসা করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের সর্বোচ্চ অবদানের প্রশংসা করেছে।দুই দেশ ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম প্রতিরক্ষা সংলাপে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে এবং লন্ডনে দ্বিতীয় সংলাপের সময় প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে একটি এমওইউ স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছে।যুক্তরাজ্য মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশের উদার আতিথেয়তার প্রশংসা করেছে এবং বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সংকটে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্তরাজ্যের মানবিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের প্রশংসা করেছে।উভয় পক্ষই দীর্ঘায়িত রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নৃশংসতার আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে আইসিজেতে রোহিঙ্গা বিচারের মামলায় সম্পৃক্ত হওয়ায় যুক্তরাজ্যকে ধন্যবাদ জানান।যুক্তরাজ্য পক্ষ বাংলাদেশের সম্প্রতি ঘোষিত ‘ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক’কে স্বাগত জানিয়েছে।উভয় পক্ষই অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ, নিরাপদ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক নিশ্চিত করার জন্য নতুন অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্য জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, আইএমও এবং আইওআরএ-সহ বিভিন্ন আঞ্চলিক ও বহুপক্ষীয় ফোরামে সহযোগিতা জোরদার করতে সম্মত হয়েছে।এ সময় উভয় পক্ষই ১৯৭১ সাল থেকে তাদের দীর্ঘস্থায়ী মূল্যবোধভিত্তিক বন্ধুত্বকে স্বীকার করে এবং ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডনে ঐতিহাসিক সফরের কথা স্মরণ করে। যুক্তরাজ্যের প্রয়াত রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং রাজা তৃতীয় চার্লস ও রানী ক্যামিলার ঐতিহাসিক রাজকীয় রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অংশগ্রহণের জন্য যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিদল তার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।বাংলাদেশী পক্ষ আশা প্রকাশ করেছে যে, মহামান্য রাজা তৃতীয় চার্লস বাংলাদেশে তার বিলম্বিত সফরের সময়সূচিটি সুবিধাজনক সময়ে পুনঃনির্ধারণ করবেন।যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার সারাহ কুক দু’দেশের অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সাথে যোগ দেন।২০২৪ সালে লন্ডনে পরবর্তী দফার এই কৌশলগত সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে।